বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||
বৈশাখ ৫ ১৪৩১
|| ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
দৈনিক বান্দরবান
প্রকাশিত: ১৫ আগস্ট ২০২২
১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট অতি প্রত্যুষে ঘাতকের আঘাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শহিদ হলেন। শহিদ হলেন তার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জামিল। ওই ঘাতককুল আর কেউ নয়, সদ্যস্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাটিতে ৯ মাস যুদ্ধের শেষ সময়টাতে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের শেষ প্রান্তে শেকড় ছড়ানো কিছু পাকিস্তানি ফেরত অফিসার, পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত অফিসারসহ তাদের কমান্ডো, আইএসআই অফিসার এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষায় শেকলভাঙা কিছু অফিসারসহ মুখোশ পরা তাদের নিকটজনদের অনেকেই এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। জড়িত ছিল ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং অন্যান্য এলাকার সেইসব পুলিশ অফিসার, যারা মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাস সাচ্চা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে বিশাল হৃদয়ের বঙ্গবন্ধুর স্নেহছায়া লাভ করে তারাও। এদের দু-একজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় মাদারীপুরের ফারাজী পরিবার।
ঢাকা ক্লাব দাপিয়ে বেড়ানো ‘হলিডে ইন গ্রুপ’ এবং চৈনিকপন্থিরাও জড়িত ছিল। এমনকি জেনারেল ওভানের শিষ্যকুল জাসদসহ যারা স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাতীয় সরকার গঠিত না হওয়ায় বা বাকশাল গঠিত হওয়ায় ক্ষিপ্ত ছিল তারাও।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মতিনের আওয়ামীবিরোধী মনোভাব আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। পদের জন্য লড়াইরত মেজর সফিউল্লাহ, মেজর জিয়া এবং খালেদ মোশাররফের মনোভাব অজানা ছিল না। এদের অধিকাংশ ছিল আওয়ামীবিরোধী এবং এরা ছক কষে ছিল একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের। শুরু থেকে এসব আঁচ করে জেনারেল ওভান মুজিব বাহিনী নামে একটি কাউন্টার ফোর্স গঠনে মনোযোগী হলেন। এ সুযোগে পাকিস্তান বসে ছিল না। তারা একদল তরুণ অফিসারকে এক এক করে ট্রেনিং দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে সুকৌশলে মাথা ধোলাই করে বাংলাদেশের মাটিতে পাঠিয়ে দিল। আগস্ট থেকে শুরু করে নভেম্বর সময়টাতে। এদের কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম হলো-রাশেদ, ফারুক, ডালিম, নুর, রশীদ, লে. কর্নেল মঞ্জুর এবং আর্টিলারিতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এক তরুণ অফিসার (মহা খেতাবপ্রাপ্ত)। তার একটি ভিন্ন এজেন্ডা ছিল।
এ প্রক্রিয়ার সময়টা হলো ২৯ আগস্ট ৭১-যে সময়টাতে কিছু বাঙালি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে পাকিস্তানি গোলন্দাজ বাহিনীর দেড় মাসব্যাপী ট্রেনিং শেষ করছে সেও মুখরোচক গল্প ফেঁধে নভেম্বরে বাংলাদেশের গোলন্দাজ বাহিনীতে যোগ দিল মেজর মঞ্জুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। আরেক দিকে চূড়ান্ত ভারতবিদ্বেষী মেজর জেনারেল ওসমানী এ সবের দিকে চোখ বুজে ঘাতক নুরকে সরাসরি এডিসি বানিয়ে নিলেন এবং মঞ্জুরকে সমর্থন দিলেন। অর্থাৎ এতে করে আমাদের তথ্য-উপাত্ত শত্রুর হাতে পাচার হওয়া সহজ হয়ে উঠল। অবস্থা কতটা জটিল ছিল তার একটি উদাহরণ-রেসকোর্সের ময়দান, জিমখানা ক্লাব, ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেস ও আবাসন। ডিসেম্বরের শেষ। কনকনে হিমেল বাতাস। একদিন দুপুরে কালো চশমা পরে জেনারেল জিয়া দুপুরের লাঞ্চে যোগ দিলেন জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে। আমি দুয়ার গোড়ায় সোফায় বসা। লাফিয়ে দাঁড়ালাম এবং একটি সংক্ষিপ্ত স্যালুট দিলাম। তিনি আমাকে উপেক্ষা করে জেনারেল সফিউল্লাহকে প্রথম বললেন-‘Things cannot go like this, some thing must be done’। এদের অন্য কথাগুলো হলো পর্দার অন্তরালে। অন্য কামরার ভেতর।
এরপর নানা শলাপরামর্শ; একদিকে ঢাকা ক্লাবসহ ধানমন্ডির আনাচে-কানাচে এবং কূটনৈতিক পাড়ায় বাংলাদেশবিরোধী শলাপরামর্শ চলছে। বোস্টারও বসেছিলেন না। যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানিদের ছেড়ে দেওয়ার চাপ বাড়ছে। এর আগে বিশাল মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব নিয়ে নিক্সনের পক্ষে জন কোনালী বঙ্গবন্ধুকে এক রকম শাসিয়ে গেলেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে মাঠে, ঘাটে নামা সৈন্যদের শলাপরামর্শ দিচ্ছিল ফারুক, রশিদ, ডালিম, নুর ও মতিন গং এবং নিু পর্যায় তাদের তল্পিবাহকরা। উচ্চাভিলাষীরা বসেছিল গুলশান ও মন্ত্রীপাড়ায়। কতিপয় তরুণ সেনা যারা শেষ সময়টাতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল, তারাও সরব ছিল। ইতোমধ্যে মিসর থেকে বেশ কিছু ট্যাঙ্ক এলো। ট্যাঙ্কের ড্রিল ঢাকার আশপাশে হচ্ছিল। ফিল্ড ইনটেলিজেনন্স ও মিলিটারি ইনটেলিজেন্স। এর প্রধান ছিল একজন ক্যাপ্টেন। এসব খবর প্রতিদিন পাঠানো হচ্ছিল ব্রিগেডিয়ার সফিউল্লাহ ও মেজর মঈনকে। এভাবেই দ্রুত এগিয়ে এলো অশুভ রাত ১৫ অগস্ট ১৯৭৫ সাল।
ফিল্ড ইনটেলিজেন্স ও মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের সামনে ট্যাঙ্কে গোলা ভরা হলো। বিষয়টি ব্রিগেডিয়ার সফিউল্লাহ সাহেবকে জানানো হলো কিনা জানা গেল না। ফলাফল শূন্য। তারপর যা হওয়ার হয়ে গেল। কান্ডারিহারা হলো বাংলাদেশ। এর পরের ঘটনা আরও নাটকীয়। রেডিওতে ডালিম ঘোষণা দিচ্ছে, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে’। আর ওই ঘোষণারত ডালিমকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য তার কাছে ছুটে গেল সেই শেষবেলার চিরচেনা অফিসার।
২০০৮-এর কোনো এক সময় আমি আমার নিজ খরচে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ওয়ার ক্রাইম্স ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি অর্জনের অংশীদার করলাম সেক্টর কমান্ডার ফোরামকে। এরা হলো সেই সেনা অফিসার যারা ২০০৮-এর আগে কখনো যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানিদের বিচারে মুখ খোলেনি। কর্নেল জামান ও কর্নেল শওকত ছাড়া কেউই মুখ খোলেনি। আমার ঘাড়ে চেপে এরা তখনই বিচারমুখী সৈনিক হলেন।
ডা. এম এ হাসান : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ
[email protected]
dainikbandarban.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়