বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||
চৈত্র ১৪ ১৪৩০
|| ১৭ রমজান ১৪৪৫
দৈনিক বান্দরবান
প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০২১
বান্দরবানের লামা থানার জীবননগর চন্দ্রপাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে চোখে পড়ে ভীতিকর ঢালের ওপারে দূরের একটি পাহাড়। সেখানে কলাইপাড়া নামে ‘ম্রো’ জনগোষ্ঠীর একটি পাড়া আছে। মানচিত্রে দূরত্ব দুই কিলোমিটার। তবে সরাসরি যাওয়ার সোজা কোনো পথ নেই। যেতে হয় পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে অনেকটা ঘুরে। চন্দ্রপাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে গতকাল রবিবার আলীকদম থেকে আসা এক প্রবীণ ম্রো বললেন, ‘এখানে পাঁচতারা হোটেল হলে কলাইপাড়ার কী ক্ষতি হবে আমি বুঝতে পারছি না। ফেসবুক থেকে জেনেছিলাম, এখানে পাঁচতারা হোটেল প্রকল্পে এক হাজার একর জমি লিজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে জানলাম, জমি দেওয়া হয়েছে মাত্র ২০ একর। আরো কত মিথ্যা যে প্রচার হচ্ছে। চন্দ্রপাহাড়ের চারপাশে আড়াই থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে চারটি পাড়া আছে। এসব পাড়ায় ম্রোদের ১২৪টি পরিবারে ৮১৭ জনের বসবাস। কলাইপাড়ায় ৩৭টি পরিবারে ২৫০ জনের বসবাস। কিন্তু প্রচার চালানো হচ্ছে, এখানে পাঁচতারা হোটেল হলে ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ হাজার লোক উচ্ছেদ হবে।’
কারা এবং কেন এই অপপ্রচার চালাচ্ছে—এই প্রশ্নে ওই ব্যক্তি বললেন, ‘তা কি আর কারো অজানা? বুঝে নেন।’ নিজের নাম, পরিচয়ও জানাতে রাজি হলেন না তিনি। বললেন, ‘ওরা খুবই খারাপ মানুষ। নিজেদের চাঁদাবাজি চালিয়ে যাওয়ার জন্য পাহাড়ে কোনো উন্নয়ন হোক, পাহাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে দেশের অন্য এলাকার যোগাযোগ বাড়ুক তা ওরা চায় না।’
কথা হলো পংদি, লাংএং, হমদ ও কানপাও নামের আরো কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদেরও একই মত। অনাবাদি চন্দ্রপাহাড়ে পাঁচতারা হোটেল হলে স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠীর লোকজনের কর্মসংস্থান হবে এবং জীবনযাত্রার মান বাড়বে বলে তাঁদের বিশ্বাস।
পর্যটনবান্ধব ওই প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের প্রচার, এই হোটেল কমপ্লেক্স ঘিরে পর্যটনের যে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠবে তা ম্রোদের সোশ্যাল প্রাইভেসি, তাদের পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তাদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্যমণ্ডিত জীবিকা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও স্বকীয়তাকে ক্রমে নির্মূলের পথে ঠেলে দেবে এবং ম্রোদের সেখানে টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাদের বাস্তুচ্যুত করা হবে এবং এলাকায় বাঙালি আধিপত্য বাড়বে।
কিন্তু স্থানীয় অনেকেই বলছেন, এসব অপপ্রচার। পার্বত্য অঞ্চলে তৎপর দুই উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জেএসএস মূল ও ইউপিডিএফ মূল এসব তথ্য ছড়িয়ে পাহাড়কে অশান্ত করে তুলছে। নিজেদের আধিপত্য ও অবাধ চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখতে তারা এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। স্থানীয়দের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। প্রকল্পের তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো বসতি নেই। কলাইপাড়া ছাড়াও চন্দ্রপাহাড়ের নিকটবর্তী অন্য পাড়াগুলো হচ্ছে কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া ও এরাপাড়া। কাপ্রুপাড়া উত্তর-পশ্চিমে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সেখানে সর্বমোট ৪৮ পরিবারের বসবাস ও মোট জনসংখ্যা ৩২০। চন্দ্রপাহাড় থেকে দোলাপাড়ার দূরত্ব দক্ষিণ-পূর্বে আড়াই কিলোমিটার। এই পাড়ায় ২০টি পরিবারের মোট জনসংখ্যা ১২০। চন্দ্রপাহাড় থেকে এরাপাড়ার দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার এবং এই পাড়ায় মোট ১৯টি পরিবার বসবাস করছে। তাদের মোট জনসংখ্যা ১২৭। ওই এলাকার ২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো বাঙালি জনবসতি নেই এবং বাঙালি একক মালিকানাধীন কোনো প্রকল্পও নেই।
স্থানীয় ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর এক হাজার থেকে দেড় হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বান্দরবান উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত যাতায়াতব্যবস্থা নিশ্চিত, পাহাড়ি জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং পাহাড়ি জনগণের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আগত পর্যটকদের কাছে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করা যাবে। দোকান ও রেস্তোরাঁ ব্যবসার মাধ্যমে স্থানীয় উপজাতীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম ওই এলাকায় বেগবান হবে বিধায় নিরাপত্তা পরিস্থিতিরও উন্নয়ন হবে। পাঁচতারা হাটেলটি নির্মিত হলে পার্বত্যাঞ্চলের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের পর্যটকের ভিড় বাড়বে। কিন্তু পাহাড়ের স্বার্থান্বেষী একটি মহল তা চায় না। তারা এই আধুনিক যুগেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে রাখতে চায়।
গত ১৭ নভেম্বর বান্দরবান শহরের বঙ্গবন্ধু মুক্তমঞ্চ এলাকায় থানচি, রুমা, লামা, আলীকদম ও বান্দরবান সদর এলাকার ম্রো সম্প্রদায়ের প্রায় এক হাজার সদস্য স্বার্থান্বেষী মহলের ওই সব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সমাবেশ করে চন্দ্রপাহাড়ে ওই প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।
অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী মহলও ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজনকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে উসকে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, চন্দ্রপাহাড়ে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের জন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে ২০১৫ সালে ২০ একর তৃতীয় শ্রেণির ভূমি ৪০ বছরের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ৩৮০ মিটার ও প্রস্থ ২১৩ মিটার। ২০১৫ সালে এই প্রকল্পের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হলে সে সময় কোনো বিরোধিতা হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ম্রো সম্প্রদায়ের কিছু লোককে সামনে রেখে এই প্রকল্পের বিরোধিতায় চিহ্নিত একটি মহল তৎপর হয়ে উঠেছে।
dainikbandarban.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়