সোমবার ১৩ মে ২০২৪ ||
বৈশাখ ৩০ ১৪৩১
|| ০৪ জ্বিলকদ ১৪৪৫
দৈনিক বান্দরবান
প্রকাশিত: ১৭ জুলাই ২০২২
বাংলাদেশ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
একাত্তর সালের ১ মার্চ পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট খেলা দেখতে বন্ধুরাসহ শেখ জামালও ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চের গণ-পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে সকলের সঙ্গে শেখ জামালও প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময়েও শেখ জামাল রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের উত্তাল ঢাকায় বন্ধুরা মিলে মিছিল দিতে দিতে তারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফিরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা লিখে যাওয়ার পরপরই পাক সেনাদের হাতে গ্রেফতার হন। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হওয়ার প্রাক্কালে পরিবারের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য বেরিয়ে পড়েন। ৩২ নম্বরের বড়িতে থেকে যান বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেসা, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। ২৬ মার্চ পুনরায় পাকিস্তানি সেনারা তাদের বাসা আক্রমণ করে। এর পূর্বেই পাশের বাসার ডা. সামাদ সাহেব তার বড় ছেলেকে পাঠিয়ে বেগম মুজিব, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেলকে তার বাসায় নিয়ে যান।
২৭ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফুফাত ভাই মোমিনুল হক খোকা এই তিনজনকে নিয়ে সাত মসজিদ রোডের উপর ধানমন্ডি (পুরাতন) ১৫ নম্বর রোডের (নতুন ৮/এ-১৭৭) ভাড়া বাসার সন্নিকটে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট ক্যাপ্টেন কিউ বি এম রহমান বাশারের বাসায় সাময়িক আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধু পরিবার ১ এপ্রিল হতে খিলগাঁও গোলচক্করে ঢোকার প্রধান পথের পাশের বাড়ীর একটি ফ্লাটে থাকতে শুরু করেন। সেখানে পরিচয় জানাজানি হলে এক সপ্তাহের মধ্যেই বেগম বদরুন্নেসার মগবাজার চৌরাস্তার নিকট প্রধান সড়কের উপর আরেকটি বাড়ীতে স্থানান্তর করেন। এই বাসায় থাকার সময় পত্রিকার ছবি দেখে পরিবারের সবাই জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী করা হয়েছে। ওই বাসাতেও পাকিস্তানি গোয়েন্দা হানা দেয়; সেখান থেকে কয়েকদিন পরে পাশেই আরেকটি বাড়ীর দোতালায় ভাড়া নিয়ে বাসা পরিবর্তন করেন। সেই বাসা থেকে ১২ মে বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হোসেন শেখ জামালসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ৯/এ (পুরাতন ১৮) সড়কের ২৬ নম্বর বাড়ীতে বন্দী করে ১৫/২০ জন পাকিস্তানি সৈনিকের পাহারায় রাখে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে মাত্র দেড় মাস সময়ে ১৯ বার অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছিল। শেখ জামাল পরিবারের অন্যান্য বন্দি সদস্যসহ নিয়মিত ‘জয় বাংলা’ বেতার শুনতেন। সেসময় পাকিস্তানিরা ‘স্বাধীন বাংলা’ বেতারকে ‘জয় বাংলা’ বেতার বলে তাচ্ছিল্য করত। এজন্য তাদের পুরো পরিবারকে বারবার খান সেনাদের ধমক খেতে হতো। এমনও বলা হয়েছিল- ‘জয় বাংলা’ বেতার শুনলে জামালকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ‘পা-বেঁধে ঝুলিয়ে পিটিয়ে পিঠের চামড়া উঠানো হবে।’
মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করাই শেখ জামালের একমাত্র লক্ষ্য ও প্রত্যয় ছিল। এজন্য তিনি বেশ কৌশলী হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে গেরিলা কায়দায় একজন পাকসেনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, তাদের সঙ্গে খাবার খান, তাদের অস্ত্র পরিষ্কার করে দেন, এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি পাহারারত পাক সেনাদের থেকে বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করার অনুমতি নেন। এরইমধ্যে ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক সাড়ে ন’টার দিকে শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে উত্তর প্রদেশের কালশীতে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস (মুজিব বাহিনী)-এ যোগ দিয়ে ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের ‘বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ’ গ্রহণ করেন। এরপর শেখ জামালের ঠিকানা হয় রণাঙ্গণের ৯ নম্বর সেক্টর। রণাঙ্গণে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল হয়ে উঠেছিলেন সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস। লক্ষ্য ছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতা এবং পিতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। একাত্তরের ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০ কিলোমিটার ভিতরে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে সেমি-অটোম্যাটিক ভারি মেশিনগানে গুলি ভরছিলেন। বিশ্ববাসী জেনে গিয়েছিল এক অদম্য সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার লক্ষ্যভেদী নিশানা।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবার। অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর তারা ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মুক্তি পান এবং পাহারারত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৯ ডিসেম্বর দুই ভাই ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল যুদ্ধফ্রন্ট থেকে সামরিক পোশাকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর সড়কের বাসায় ফিরে আসেন।
dainikbandarban.com
সর্বশেষ
জনপ্রিয়