প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড় কন্যা খ্যাত জেলা বান্দরবান

পার্বত্য জেলা তিনটির অন্যতম একটি বান্দরবান। হাত বাড়ালেই মেঘের পরশ। চঞ্চলা ঝরনার অবিরাম ছুটে চলা আর শ্যামল প্রকৃতি সব মিলিয়ে যেন এক টুকরো স্বর্গ। এখানকার সর্বত্রই রয়েছে দেখার মতো অসংখ্য জায়গা।
নীলাচল : এই নীলাচল পর্যটন স্পটটি বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ায় অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ফুট উপরে এর অবস্থান। ঘুরে দেখা যাবে নীলাচলের বাইরের দিকটা ছিন্নভিন্ন পাহাড় দ্বারা সজ্জিত হলেও ভেতরটা খুবই প্রশান্ত। কোথাও বিস্তীর্ণ দিগন্তের ঢালে ঘোরাঘুরির আঁকা বাঁকা রাস্তা, পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর পাড়া, আর তার সঙ্গে রূপালী ঝর্ণা-ঝিরিতে যেন শিল্পীর আঁকা ছবি। মেঘহীন আকাশে এই নীলাচল থেকেই কক্সবাজার সমুদ্র বা চট্রগ্রামের আনোয়ারর পারকি সমুদ্র সৈকতের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকরা। শহর ছেড়ে বান্দরবান-চট্রগ্রাম সড়কের প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে বা গাড়িতে বাঁ দিকের ছোট্ট সড়কটিই নীলাচলের প্রবেশ পথ। এই পথে প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ে উঠতে হবে তবোই মিলবে বান্দরবান জেলা প্রশাসন পরিচালিত নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র।
বগালেক : রুমা বাজার থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের এক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় গাঢ় নীল জলের এই লেকে। তবে ১৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু এই লেকের অপার সৌন্দর্য দেখে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় মুহূর্তেই। এখানে রাত কাটানোর সুব্যবস্থা আছে।
তিন্দু: তিন্দুর পাশ দিয়ে পাহাড়ি নদী সাঙ্গু বয়ে যাওয়ার কারণে মেঘ, নদী, জলপ্রপাত, রহস্য, রোমাঞ্চ সবই এখানে পাওয়া যায়। তাই তিন্দু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ভ্রমণকারীদের জন্য অন্যতম প্রিয় আকর্ষণ। বান্দরবান থেকে থানচি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭৯ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথে চারপাশের সুন্দর প্রকৃতি দেখতে দেখতে চোখ ও মন দুটোই সতেজ হয়ে যায়। থানচি ঘাট থেকে ছোট ইঞ্জিনের নৌকা ভাড়া করে প্রায় দুই ঘণ্টায় থানচি থেকে তিন্দু পৌঁছানো যায়। এ সময় যাত্রাপথে সাঙ্গু নদীর মনোমুগ্ধকর রূপের অভিজ্ঞতা নেয়া যায়।
কেওক্রাডং: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ১৭২ ফুট উঁচু এই পর্বতটি রুমা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ছোট ও বড় পাহাড় পর্বতের সমন্বয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই দুর্গম এলাকা। কেওক্রাডং বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত। সবুজ পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য, শীতল ঝর্ণা, আঁকাবাঁকা পথ, পাহাড়ি রাস্তার ধারে, পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের লুকোচুরির খেলা। এই সব কিছু মিলে মনে নেশা ধরিয়ে দিবে। রুমা থেকে কেওক্রাডং যাওয়ার পথে মাঝে মুনলাই বম পাড়া নামে একটি সুন্দর গ্রাম রয়েছে। এই সড়কে বগালেকের পরে দার্জিলিং পাড়া নামে আরোএকটি বম নৃ গোষ্ঠীদের গ্রাম আছে যেটি দেখার মত সুন্দর। অনেক পর্যটকই যাত্রা বিরতি দিয়ে এই অপূর্ব গ্রামটিতে বিশ্রাম নেন।
নাফাখুম: নাফাখুমের খুমের মানে হচ্ছে জলপ্রপাত আর এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাতগুলোর একটি। স্থানীয় লোকজন এটিকে রেমাক্রি জলপ্রপাত বলে থাকে। এখানে একবার ভ্রমণ করলে ভ্রমণকারীরা বারবার আসতে চায়। লোকেরা একে বাংলাদেশের নায়াগ্রা জলপ্রপাত বলে ব্যাখ্যা করে। সাঙ্গু নদী থেকে নৌকা নিয়ে রেমোক্রি হয়ে নাফাখুমে যেতে হয়। এই যাত্রা পথে তিন্দু, রাজাপাথর এবং পদ্মঝিরিও দেখে নেয়া যায়। বর্ষাকালে নদীতে পানির প্রবাহের অনেক চাপ থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাফাখুম যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে শীতের মৌসুমে পানির স্তর অনেক নিচে থাকায় নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় না। তদনুসারে, নাফাখুম ভ্রমণের সর্বোত্তম সময় বর্ষাকালের পরে এবং শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগে।
প্রান্তিক লেক : বান্দরবান শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের পাশেই অবস্থিত এই অপূর্ব লেকটি। বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে এখানে যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টার মতো।
লামা : বান্দরবান শহর থেকে ৯৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ স্থানটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি মেডিটেশন সেন্টারের জন্য জায়গাটি সুপরিচিত। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে পর্যটন স্পট মিকির ও মিরিঞ্জা ভেলি, আর সেনাবাহিনী নির্মিত শিশুপার্কটিও সুপরিচিত। বান্দরবান থেকে দুপুর ২টায় পূর্বাণী পরিবহন ও ৩টায় চাঁদের গাড়ি ছেড়ে যায় লামার উদ্দেশে।
নীলগিরি রিসোর্ট : বাংলাদেশের দেশের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০০ফুট উপরে অবস্থিত বান্দরবানের আকর্শণীয় পর্যটন স্পট নীলগিরি এটি দেশের অন্যতম একটি উঁচুপর্বত শৃঙ্গ। নীলগিরির পুরো এলাকাটি মেঘে ঢেকে থাকার কারণে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা নীলগিরিকে মেঘের রাজ্য বলে থাকেন। নীলগিরির সূর্যোদয়ের মুহূর্তটি আশ্চর্যজনক এবং কুয়াশাচ্ছন্ন সব মৌসুমেই এখানে শীতকালের মত লাগে। এই র্পটন স্পটটি যেকোনো পর্যটককে চমকে দিতে পারে। এখানে মনোরম হেলিপ্যাড নীলগিরির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটি। পর্যটন এলাকাটির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
আলী সুড়ঙ্গ : লামা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে রহস্যঘেরা এ সুড়ঙ্গে যাওয়ার একমাত্র বাহন চাঁদের গাড়ি। তবে এখানে যাওয়ার আগে পাহাড়বান্ধব জুতা, দা, লাঠি, ব্লিচিং পাউডার, লবণ সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না।
নাইক্ষ্যংছড়ি : সীমান্তঘেঁষা এ উপজেলা শহরটিতে জারুলিয়াছড়ি ও নাইক্ষ্যংছড়ি লেক, বিজিবির দপ্তর, উপবন পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও রয়েছে ৬৫ হেক্টর ভূমির ওপর স্থাপিত গয়াল প্রজনন কেন্দ্র।
মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স : শহরতলি থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে ৯০ একর ভূমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এ পর্যটন কমপ্লেক্সটি। এখানকার কৃত্রিম লেক আর পাহাড়ের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে পর্যটকদের।
চিম্বুক পাহাড় : শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পাহাড়টি বান্দরবানের অন্যতম চিত্তাকর্ষক স্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ফুট উঁচু এ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে দেখা যায় দূরের সৈকত।
রাজবাড়ি : বান্দরবানে অবস্থিত বহু বছরের পুরনো বোমাং রাজার বাড়িটি এখনো মুগ্ধ করে সবাইকে। প্রতিবছর শীতকালে এখানে রাজপুণ্যাহ মেলা বসে।
শৈলপ্রপাত : বান্দরবান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক সড়ক পথে অবস্থিত শৈলপ্রপাতের অবিরাম জলধারা মুগ্ধ করে সবাইকে। এ পর্যটন কেন্দ্র দেখার মতো।
বৌদ্ধমন্দির : শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-চন্দ্রঘোনা সড়কের পুলপাড়ায় জাদির পাহাড়ে অবস্থিত অপূর্ব কারুকার্যময় এ মন্দিরটির অবস্থান। আকর্ষণীয় এ স্বর্ণমন্দিরটির নাম বুদ্ধধাতু জাদি। এগুলো ছাড়াও বান্দরবানে দেখার মতো আরও আছে জাদি পাহাড়, রাজবন বিহার, শঙ্খ নদীসহ (সাংগু) অনেক কিছু।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি বান্দরবানে যায় সেন্টমার্টিন পরিবহন,ইমপেরিয়াল,এস আলম সার্ভিস, ইউনিক বাস সার্ভিস, ডলফিন সার্ভিস, সৌদিয়া পরিবহন এবং শ্যামলী পরিবহন। এছাড়া যে কোনো বাস বা ট্রেনে চট্টগ্রাম এসে সেখান থেকে যাওয়া যায় বান্দরবান। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের বাসগুলো ছাড়ে বহদ্দারহাট থেকে। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আধাঘণ্টা পরপরই বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায় সাঙ্গু ট্রাভেলস্, মার্সা, পূর্বাণী, পূরবী, এবং পূবালী বাসগুলো। পৌঁছতে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা।
কোথায় থাকবেন
বান্দরবানে থাকার জন্য জায়গা হলো পর্যটন মোটেল। এখানে এসি, নন এসি দু ধরনের কক্ষই পাবেন।ইকো সেন্স রিসোর্ট, গিরিরাজ রিসোর্ট, ডিমোর,হোলেট গার্ডেন সিটি,হোটেল আরণ্য, মেঘলা টুরিস্ট রিসোর্ট, গাইড ট্যুরসের হলিডে রিসোর্ট, গ্রীন রিসোর্ট, মেঘলা, রুমা বাজার লামি হিল সাইড রিসোর্ট। এছাড়া শহরের ভেতরে রয়েছে হোটেল প্লাজা বান্দরবান, হোটেল পূরবী এবং হোটেল ফোর স্টার আরো অনেক হোটেল রয়েছে।