জুমের ধান কাটা শুরু, সবুজ পাহাড়ে এখন সোনালী রং লেগেছে।

প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ের ঢালু ভূমিতে উৎপাদিত জুম চাষের ধান কাটা শুরু হয়েছে। জুমিয়াদের মুখে হাসি ফুটেছে। সবুজ পাহাড় এখন সোনালী রঙে রঙিন। চোখের দৃষ্টি যতদূর যায় বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দূর থেকে দেখা যায় সবুজ পাহাড়ের জুমের পাকা সোনালি রঙের পাকা ধান।
জুমের পাকা ধানের গন্ধ ছড়াচ্ছে বান্দরবানের পাহাড়ি জনপদে। সবুজ পাহাড়ে এখন সোনালী রং লেগেছে। জেলার থানচি উপজেলার পাহাড়ের ঢালু জমিতে উৎপাদিত ধান কাটতে শুরু করেছেন জুমিয়ারা। ধানের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে লাগানো মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা ও চিনাল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। উৎসবমুখর পরিবেশে পরিবার ও প্রতিবেশিদের নিয়ে ধান ও সবজি সংগ্রহ করছেন তারা।
চাষিরা জানান, এ বছর বৃষ্টি দেরিতে হওয়ায় জুমের ধান রোপণে সময়ের ব্যবধান বেশি হয়েছে। কোথাও কোথাও ধান পেকে যাওয়ায় তা কাটতে শুরু করেছেন জুম চাষিরা। অনেক স্থানে জুমের ধান এখনো সবুজ। কোথাও কোথাও ধান পাকতে শুরু করেছে। ওইসব এলাকার চাষিরা ধান কাটার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
জানা গেছে, প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জুমের জায়গা নির্ধারণ করা হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গার জঙ্গল পরিষ্কার করেন জুমিয়ারা। কাটা জঙ্গল রোদে শুকানোর পরে মার্চ-এপ্রিল মাসে আগুন দেওয়ার জন্য প্রথমে ফায়ারিং লাইন করে জঙ্গল পোড়ানো হয়। এপ্রিল মাস জুড়েই জুমের জায়গা পরিষ্কার করে ধানের চারা রোপণের জন্য প্রস্তুত করে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেন চাষিরা।
বৃষ্টি হলেই জুমের জায়গায় ধানসহ সাথী ফসল রোপণ করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমের ধানসহ সাথী ফসল রোপণ করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকতে শুরু করে। যারা একটু দেরিতে চারা রোপণ করেন তাদের ধান দেরিতেই পাকে।
আগস্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পযর্ন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূলঘরে স্থানান্তর করার পর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে ঘরে ঘরে জুম ধানের নবান্ন উৎসব।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে থানচি উপজেলার বলিপাড়া ইউনিয়নের কমলা বাগান পাড়া। সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) এই এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিলন ত্রিপুরা (৪০) পরিবার ও ১৫ জন প্রতিবেশীকে নিয়ে জুমের পাকা ধান কাটছেন।
মিলনের জমিতে কাজ করছিলেন প্রতিবেশী পুষ্পরাণী ত্রিপুরা। তিনি বলেন, আমরাও জুম চাষ করেছি। আমাদের জুমের ধান এখনো কাটার উপযুক্ত হয়নি। প্রতিবেশীর জুমের পাকা ধান কাটতে সহযোগিতা করছি আমরা। কিছুদিন পর আমাদের ধান কাটার উপযুক্ত হবে। এখন যাদের ধান কাটতে সহযোগিতা করছি, তারাও তখন আমাদের ধান কাটতে সহযোগিতা করবেন।
মিলন ত্রিপুরা বলেন, এ বছর ৫ একর পাহাড়ে ১২ আড়ি ধানের জুম করতে পেরেছি। এ বছর জুমের ধান তেমন ভালো হয়নি। যখন বৃষ্টির দরকার ছিল, তখন বৃষ্টি হয়নি। যখন রোদ দরকার ছিল, তখন অতিবৃষ্টি হয়েছে। সময় মতো রোদ-বৃষ্টি হলে জুমের ধান ভালো হয়। ধান কাটার উপযুক্ত সময়ে টানা ৪-৫ দিন বৃষ্টি হওয়ায় অনেক জুমচাষির পাকা ধান নষ্ট হয়েছে। এ বছর জুম থেকে ২০০ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছি। জুমের ধানে কোনো মতে বছর চলে যাবে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় ২০২১ সালে জুমের চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমিতে, আর উৎপাদন হয়েছিল ১৩ হাজার ৪৬৭ দশমিক ২২ মেট্রিক টন চাল।
২০২২ সালে চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে, আর উৎপাদন হয়েছিল ১১ হাজার ৪১৮ দশমিক ১২ মেট্রিক টন চাল।
২০২৩ সালে জুম চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে, আর উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৪৮৯ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন চাল।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে জুম চাষ হয়েছিল ৮২৬৭ হেক্টর এবং চাল উৎপাদন হয় ১২,৪৯৯ মেট্রিক টন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে জুম চাষ হয়েছিল ৭৩০০ হেক্টর জমি, আর চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে জুম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৩৬০ হেক্টর জমিতে, আর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ এমএম শাহ নেয়াজ জানান, জেলায় চলতি বছর প্রায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আউসের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু জুমের আবাদই বেশি প্রায় সাড়ে সাত হাজার হেক্টর।
জুমে ইদানীং উপসি জাতের ধানও চাষ করা হচ্ছে, সেটাও কম নয়-প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার যখন কৃষকেরা এপ্রিল-মাসে জুমে বীজ বপন করে তখন সময়মতো বৃষ্টি পেয়েছে।
তিনি আরো জানান, পার্বত্য অঞ্চল হওয়ার কারণে বৃষ্টি সব জায়গায় সমানভাবে হয় না। যে কারণে উৎপাদনে তারতম্য হয়। একেক জায়গার ফলন একেক রকম হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি উপজেলায় জুমের ধান কাটা শুরু হয়েছে। অন্যান্য উপজেলায় জুমের ধান কাটা শুরু হবে। জুমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগ বিভিন্ন পরামর্শ এবং স্থানীয় জাতের সঙ্গে হাইব্রিড জাতীয় ধান উৎপাদন করার জন্য উৎসাহ ও পরামর্শ প্রদান করছে চাষিদের